নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাঠপট্টি এলাকার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা আবদুল মতিন মোল্লা। তিনি বলেন, ভারতের দক্ষিণের চিত্তৌর রাজ্যের রাণী পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলো দেশ বিদেশের রাজ-রাজারা। তাকে নিজের করতে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে অনেক। আমাদেরও এক জৌলুসপূর্ণ ‘পদ্মাবতী’ ছিল। কিন্তু সময়ের ফেরে সে রূপ হারিয়েছে’। মতিন মোল্লা’র ‘পদ্মাবতী’ কোনো রূপবতী নারী বা রাণী নয়। কাঠপট্টি এলাকার ছোট একটি অংশ। যেটা চামড়া (ট্যানারি) শিল্পের জন্য এই দেশের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিখ্যাত ছিল একসময়। কিন্তু এই শিল্পের বেহাল দশার কারণে এখানে এখন আর চামড়া নিয়ে ব্যস্ততা নেই। কিন্তু মাত্র বছর পাঁচেক আগেও নাকি এমন অবস্থা ছিল না।
সময়ের বিবর্তনে সেখানকার চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউ ছেড়েছেন পদ্মাবতী, আবার কেউ পদ্মাবতী এলাকায় নিজ স্থানে থেকেই শুরু করেছেন ভিন্ন ব্যবসা। শুধু ব্যবসায়ী নয়, চামড়া শিল্পের সঙ্গে যে শ্রমিকরা জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই ত্যাগ করেছেন পদ্মাবাতী। আর যারাও বা এখনও রয়েছেন তারাও খুব একটা ভালো দিন কাটাচ্ছেন না। আর এগুলোর মূল কারণ হিসেবে রয়েছে চামড়ার দরপতন এবং কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
আগে ‘পদ্মাবতী’ এলাকায় প্রায় ২০০ জন ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর এসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নির্দিষ্ট মৌসুমে কাজ করতেন হাজার খানেক শ্রমিক। পুরো বরিশাল বিভাগের পশুর চামড়া সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ঢাকার পাইকারদের কাছে পাঠাতেন তারা। এখন সেখানে দুই থেকে তিনজন ব্যবসায়ী কোনোরকমে ব্যবসাটা টিকিয়ে রেখেছেন।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বরিশাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং পদ্মাবতী’র পুরনো বাসিন্দা শহিদুর রহমান শাহীন। তিনি জানান, পারিবারিকভাবে বাপ – দাদার আমল থেকেই তিনি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় এবং পাইকারদের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে তাকে। তাই গত দুবছর যাবত ব্যবসা পরিবর্তন করে এখন কাপড়ের দোকান খুলেছেন তিনি। কিন্তু হাতে গোনা যেকজন ব্যবসায়ী এখনো এই ব্যবসায় আছেন তারা সমিতির দায়িত্ব না নেয়ায় তাকেই বাধ্য হয়ে সমিতি চালাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা চামড়া ব্যবসা ছেড়েছি মূলত ঢাকার পাইকার এবং ট্যানারি কারখানার মালিকদের জন্য। তাদের কাছে আমাদের কোটি কোটি টাকা পাওনা। তারা আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু চাহিদা মাফিক টাকা দেয় না। এছাড়া বর্তমানে চামড়ার দাম কম। ছোট পশু যেমন ছাগলের চামড়ার কোনো মূল্য নেই। বড় পশুর চামড়ার জন্য সর্বোচ্চ ১০০ টাকা বরাদ্দ থাকে। এই মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে আমাদের খরচের টাকাই ওঠে না।
অন্যদিকে পদ্মাবতী এলাকায় দীর্ঘদিন চামড়া ব্যবসায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন রতন সন্যামত। তিনি দীর্ঘদিনের পেশা বদলে এখন কাঠপট্টি এলাকায় একটি ফলের দোকানে কর্মচারী। তিনি জানান, শুধু কোরবানির সময়ে কাজ করে যা উপার্জন হতো তা দিয়েই সারা বছর চলতো তাদের। বিভিন্ন স্থান থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহ করা, সেগুলোতে লেগে থাকা চর্বি – মাংসের অংশবিশেষ তুলে ফেলা, লবণ কিংবা রাসায়নিক দিয়ে সেগুলো সংরক্ষণ এবং সর্বশেষ ঢাকায় ট্যানারি কারখানায় পাঠানোর জন্য পরিবহনে তোলার ব্যবস্থা করতেন তারাই।
দীর্ঘ ১৭ বছর ‘পদ্মাবতী’র চামড়া শিল্পে জড়িত থাকা এই শ্রমিক বলেন, কয়েক বছর আগে হঠাৎ ঢাকার পাইকাররা চামড়ার দাম এতটাই কমিয়ে দিলো যে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া পরিবহনের খরচই ওঠাতে পারতেন না। অগত্যা একের পর এক ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ায় তার মতো শত শত শ্রমিক পেটের দায়ে পদ্মাবতীকে ভুলে এখন অন্যত্র নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যস্ত’।
তবে চামড়ার দাম কমে গেলেও চামড়াজাত পণ্যের দামের ঊর্ধ্ব গতি ঠিক মেনে নিতে পারেন না ষাটোর্ধ্ব মতিন মোল্লা। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে পদ্মাবতী’র অলিতে গলিতে হেঁটে চলে জীবন পার করলাম। চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় যখন দেখি একের পর এক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখা পশুর চামড়ার দোকানগুলোতে তালা পড়ছে তখন খারাপ লাগে। কিন্তু চামড়ার জুতার দোকানে গিয়ে যখন দেখি প্রতিনিয়ত চামড়াজাত পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে তখন মনের মধ্যে খটকা লাগে। শুধুই চামড়ার দাম না থাকায় শৈশব থেকে দেখে আসা চামড়া ব্যবসায়ীদের দুর্দশায় পড়তে হচ্ছে এমনটা তখন আর বিশ্বাস হয় না। মনে হয় চামড়া শিল্প ধ্বংসের পিছনে দেশে অন্য কোন ষড়যন্ত্র চলছে।
Leave a Reply